বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো– এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং বিভিন্ন অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

নানান অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে কেমন হলো এবারের প্রস্তাবিত বাজেট? বাজেটের সার্বিক বিষয় নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার সাথে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা।

তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল্লাহ আমান।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?

সায়মা হক: প্রথমত আমার যেটা মনে হয়েছে বাজেটটা অন্যান্য বছরের তুলনায় ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। খুব বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করিনি, ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন ছাড়া। সার্বিকভাবে বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। আবার আরেকটি দিক যদি বলি সেটা হচ্ছে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি চ্যালেঞ্জ বা সামগ্রিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; তবে সেটা যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়।

ইতিবাচক দিক হলো, বাজেটের আকার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা হলেও কম রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আরও দুই-একটা বিষয় হলো, কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে যে উৎসে কর, সেটা কমানো হয়েছে (২ শতাংশ কর থেকে ১ শতাংশ কর নেওয়া হয়েছে)। এবং আরও কয়েকটি পণ্যে কিছু কাটছাঁট করা হয়েছে। আমদানি শুল্ক, মূসক এসব ক্ষেত্রে; যেটি আসলে আমাদের উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখার; যা মোট বাজেটের ১৪.২৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

সায়মা হক: ঋণ পরিশোধ করার কথা যখন বলি তখন প্রথম কথা হচ্ছে ঋণটা যদি কম নেওয়া হয় তবে সুদ পরিশোধও কম হবে। সুতরাং ঋণটা কখন কম নেওয়া দরকার হবে, প্রথম বিষয় হচ্ছে, যদি আমরা রাজস্ব আহরণ বাড়াতে পারি। এখন যদি রাজস্ব আহরণ বাড়াতে না পারি আর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার কথা যদি চিন্তা করি অর্থাৎ ডলারের সাপেক্ষে আমাদের টাকার যে মূল্যমান যেহেতু এক ধরনের নেতিবাচক অবস্থান দেখাচ্ছে, সেহেতু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা বলতে পারি, এটা একটা নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করবে। যেমন– আমি যদি বলি যে, আমদানি শুল্ক, অভ্যন্তরীণ ঋণ, যেটা আপনি প্রথমেই বললেন বাজেটের ১৪-১৫ পার্সেন্ট। তার অর্থ কী দাঁড়ায়, ঋণ পরিশোধে যদি একটা বড় অংশ চলে যায় তাহলে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে অর্থায়ন করার জন্য অর্থ কমে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে প্রথম সমস্যা। তখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই খাতগুলোতে টান পড়বে।

তো সার্বিকভাবে আমি যদি ঋণের কথা বলি বা বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য যে দুটো খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়, একটা ঋণ যেটা বৈদেশিক ঋণ, সেটা বৈদেশিক মুদ্রাতেই পেমেন্ট করা হয়। হয়তো এভাবে চিন্তা না করে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করা যায়। বৈদেশিক ঋণের একটা বিষয় হচ্ছে যে যত বেশি বৈদেশিক ঋণ তার মানে আমার তো স্বাভাবিকভাবে এই ঋণটা পরিশোধ করতে হবে ডলারে। এবং যদি আমাদের মুদ্রার মান খুব ভালো/স্ট্রং না হয়, যত দিন যাবে তত কিন্তু এই ঋণের বোঝাটা আমার বাড়তে পারে। ঋণগ্রস্ত জাতি হিসেবে অর্থনীতিতে ঋণ বাড়তে থাকবে। এটা কখনোই শুভ লক্ষণ নয়। এটা স্বাভাবিকভাবেই সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে। তবে আমি অভ্যন্তরীণ ঋণের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেব।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে তার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, এর কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

সায়মা হক: অভ্যন্তরীণ ঋণের ব্যাপারটা হচ্ছে সরকার যখন অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নিয়ে নিচ্ছে, তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রভাব কমে যাচ্ছে। অলরেডি আমাদের কিছু সংকট আছে। সেখানে যদি ব্যক্তি খাতে ঋণ আরও কমে যায়, সেটা কিন্তু ব্যক্তিগত বিনিয়োগের জন্য ভালো না। দ্বিতীয়ত যে বিষয়টা, সরকার যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ, যেটা নেওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে। তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে ব্যাপারটা, সেটা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়। আমার কাছে এটি একটি সেনসিটিভ বিষয়। সে কারণে ঘাটতি যখন থাকবে অর্থাৎ ঋণ যখনই নেবেন, তখনই সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হবে। আপনি দেখেন সঞ্চয়পত্রের হিসেবে যে টাকাটা আছে, সেটা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আছে। এবং সেটা কিন্তু একটা বড় অংশ সামাজিক নিরাপত্তার। তো মূল যে বিষয়টা আমি বলব, সেটা হচ্ছে অন্য যে খাতগুলো, সেখানে আমাদের কম্প্রোমাইজ করতে হয়। এবারের বাজেট স্বাভাবিকভাবে একটু সংকোচনমূলক বাজেট। এ ধরনের বাজেট যখনই হয়, তখন কিন্তু খুব বড় ধরনের ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগ হবে বা বড় কর্মসংস্থান হবে– সেটা আশা করা যায় না।

এবং সেই হিসেবেও যদি আমরা দেখি, স্বাভাবিকভাবে কিছু বিনিয়োগ বা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এখনও আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগুলো কাটছাঁটও করা হয়েছে, করও বাড়ানো হয়েছে। আপনি যদি একদম সাবহেড ধরে ধরে দেখেন। তো সেইগুলো আসলে সার্বিকভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

সায়মা হক বিদিশা: কর্মসংস্থান এবং তার সাথে প্রবৃদ্ধি। এই দুটোর সাথে মূল্যস্ফীতির বিপরীতমুখী সম্পর্ক আছে। সেই কারণে আপনি যদি মূল্যস্ফীতিটাকে ঠিক করতে চান, যেটা অবশ্যই অগ্রাধিকার এই মুহূর্তে বিনিয়োগের বদলে আমাদের মাথায় থাকা উচিত। তখন কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে খুব ব্যাপক পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিবর্তন হয়তো হবে, ইতিবাচকভাবে। সুতরাং আমার কাছে যেটা মনে হয়, যেটা দরকার সেটি হলো ক্ষুদ্র এবং মধ্যম আকারের শিল্পগুলো, সেগুলো উজ্জীবিত করার জন্য যদি ছোট ছোট কিছু সুবিধা দেওয়া হতো, তাহলে লোকাল কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হতো এবং সেই জায়গাগুলোতে আমার যা মনে হয়েছে বৃহৎ শিল্পগুলোতে খুব বড় ধরনের কোনো আশা যেহেতু করা যাবে না। সেহেতু ছোট ছোট এই শিল্পের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেমন– আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যবসায়িক সমস্যা, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা, উঁচু সুদের হার, ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা– এসব বিষয়ে যদি একটু ফ্লেক্সিবিলিটি/সহায়তা দিতে পারতাম, তাহলে কিন্তু একটা থ্রেশহোল্ড তৈরি করতে পারতাম। তাছাড়া একেবারে ছোট ব্যবসায়ী যারা, তাদের জন্য আমরা ঋণ সুদের হারটা কম রাখা, তাদেরকে কিছুটা ট্রেড লাইসেন্স বা নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া বা শিথিল করার মাধ্যমে আসলে কর্মসংস্থান তৈরি করা যেত। ওই জায়গাটাতে আমার মনে হয় আরও বেশি দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত ছিল, যেটা আমরা সেভাবে দেখিনি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটে ১৫ শতাংশ কর দিলেই যেহেতু চলবে– এটি তাই কর ফাঁকি দিতে উৎসাহিত হবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

সায়মা হক: প্রথমত নৈতিকতার বিষয়টা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে। কারণ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অর্থনীতি, সে অর্থনীতিতে আসলে নৈতিকতার বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা আমরা বলে থাকি। তো সেই হিসেবে নৈতিকতাটাই প্রথম গুরুত্ব। এর পাশাপাশি পূর্ববর্তী যে বছরগুলোতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে খুব বড় ধরনের ইতিবাচক ফল আমরা পাইনি। বরঞ্চ আমার মনে হয়, যে টাকাগুলো হয়তো পাচার হয়ে যায়, সেই টাকাগুলো দেশে রাখার জন্য যে সার্বিক অবকাঠামো, ব্যবসা করার যে সুযোগ-সুবিধা দিত সেখানে সার্বিক ইতিবাচক পরিবর্তন আসত। তাহলে হয়তো কিছু টাকা দেশে থাকত। কালো টাকার যে অংশটা খেলাপি ঋণের মাধ্যমে না, সেটা দেশে বিনিয়োগ করা যেত। সুতরাং ওই ধরনের কোনো সুযোগ না দিয়ে দেশের বিনিয়োগের পরিস্থিতিটা তৈরি করলে অনেকে হয়তো কালো টাকা হিসেবে বিদেশে না পাঠিয়ে দেশে বিনিয়োগ করত। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টা আমি বলব সেটা হচ্ছে, এত বছরেও আমরা তেমন একটা সুফল পাইনি। তো এ বছর হঠাৎ করে সুফল পাব বলে আমার মনে হয় না। মূল বিষয়টা হচ্ছে, একটা ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি আমি যদি ইতিবাচক করতে পারি, তাহলে সৎভাবে যারা ব্যবসা করতে চায়, তারা প্রচুর উৎসাহিত হবে। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ দিলে যারা সৎ ব্যবসায়ী তারা নিরুৎসাহিত হয়ে যায়। আর সেটা ব্যবসা করার ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। আর আমাদের আসলে দেখা উচিত কালো টাকা হয়ে যাওয়ার পরে সেটাকে সাদা বানানোর পরিবর্তে কালো টাকা না হওয়াটাকে কীভাবে বন্ধ করা যায়। এবং এই জায়গাগুলোতে বিশেষ করে খেলাপি ঋণ সেখানে একটা বড় পরিমাণের কালো টাকা আছে। যারা খেলাপি হচ্ছে, তারা কারা– ব্যাংকগুলো জানে। তাদের টাকার উৎসগুলো দেখা এবং টাকাগুলো দেশে রেখে, খেলাপি ঋণগুলোকে রিসল্ভ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে কিন্তু বেশি ইফেক্টিভ হয়। অর্থাৎ আমাদের নৈতিকতার জায়গা থেকে কালো টাকাকে সাদা না বানিয়ে কালো টাকা হওয়াকে বন্ধ করাটাই বেশি যৌক্তিক। আর আপনি যে ৩০% ট্যাক্সের কথা বললেন, সেটা ভালো। তবে এখানে আরেকটা কথা আছে। যেমন– আপনি দেখেন ২০ লাখ টাকার ওপর যে ট্যাক্সটা, সেখানে ওপরে আরও ট্যাক্স থাকার কথা ছিল। আমার যেটা মনে হয় যে এ রকম ৩০% ট্যাক্স স্ল্যাব না দিয়ে আগের ২৫% থেকে আরেকটা বড় ট্যাক্স স্ল্যাব দিতে পারত, যে ৫০ লাখের ওপরে বা ১ কোটির ওপরে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

সায়মা হক: প্রথমত মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব দুটোকেই জোরদার হতে হবে। মুদ্রানীতি কিছু কারণে আমাদের দেশে খুব বেশি কাজে দিচ্ছে না। সে কারণে আমাদের বিকল্প কিছু পথ বা সম্পূর্ণ কিছু পথ রাজস্ব নীতির দিকে চিন্তা করছি। রাজস্ব নীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বাজেট। কারণ হচ্ছে আমরা গত বছরও যে মূল্যস্ফীতির টার্গেট নিয়েছিলাম সেই টার্গেটে থাকতে পারিনি। এ বছরও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার। কিন্তু তা খুব বেশি কাজে আসেনি। সুতরাং সেই কারণেই আশঙ্কা যে মুদ্রানীতি বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসিগুলো খুব বেশি কাজ করছে না। কিন্তু কেন কাজ করছে না– সেটা নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা আছে। কারণ, অনেক আগেই এটা করার কথা ছিল। অনেক দিন ধরে যেহেতু এটা হয়ে আছে, আমি আমার অর্থনীতির জ্ঞান দিয়ে যতটুকু বুঝি, খুব দ্রুত মূল্যস্ফীতির সমাধান হবে না। এবং সে ক্ষেত্রে কী করা যেত? একটা উপায় যেমন, করমুক্ত আয়সীমা, সেই জায়গাটাতে যারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত, তাদের ক্ষেত্রে এটা যদি চার লাখ করে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে যে কিছু মানুষ যারা খুব একটা ধনী না; যাদের কর দিতে হবে না। সে ক্ষেত্রে একটা শ্রেণি কিন্তু কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত। সরকার বলছে যে রাজস্ব আহরণ কম, আবার আপনি বলছেন যে মূল্যস্ফীতিতে কাটছাঁট করার কথা। এ ক্ষেত্রে আমার যুক্তিটা হচ্ছে, এখানে একটা সংস্কার করা দরকার। আমাদের ট্যাক্সের নেট বাড়ানো দরকার। এবং যারা অতি ধনী আছেন, তাদের উচ্চ হারে করের আওতায় আনা। আমাদের দেশে আরেকটা জিনিস আছে, যেটা হচ্ছে সারচার্জ। এ ক্ষেত্রে এটি কিন্তু অপরিবর্তিত। এখানেও আরও কয়েকটি স্ল্যাব বসানো যায়। আমাদের এক-তৃতীয়াংশের মতো আসে প্রত্যক্ষ আয়কর থেকে, বাকি আসে পরোক্ষ কর থেকে। ওই পরোক্ষ করের জায়গাটা কমিয়ে যদি আবার প্রত্যক্ষ করটা বাড়ানো যেত এবং পরোক্ষ করটাকে আমি কাটছাঁট করার সুযোগ পেতাম, তাহলে এটাকে কম্পলসারি করতে পারতাম। আরেকটা বিষয়, বাজার ব্যবস্থাপনাটা খুব শক্তভাবে করতে হবে। যেটা আমাদের ব্যাখ্যার বেশি অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি, সেটাকে আমাদের নাগালে আনা। তাছাড়া আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো দরকার। আমাদের যে টিসিবির পণ্য, এগুলো অনেক গুণে বৃদ্ধি করা দরকার। এবং সেখানে ট্রাকের পণ্যগুলো সাবসিডাইজড করা, রেশনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ব্যক্তি খাতে যারা রয়েছে তাদেরকে আমরা যখন প্রণোদনা দেই, তার সাথে যদি শ্রমিকের স্বার্থটাকে কিছুটা সংশ্লিষ্ট করতে পারি তাহলে কিন্তু অনেকটা স্বস্তি পেত শ্রমিকরা। শহরাঞ্চলে যারা গরিব আছেন– বস্তিতে থাকেন, আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, তারা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছেন। কারণ, গ্রামে আপনার টুকটাক খাবার জোগাড় হয়ে যায়। শহরে কিন্তু এটা হয় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, যা শীর্ষ পাঁচ ব্যয় বরাদ্দ খাতের একটি। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

সায়মা হক: দেখুন, আমরা কিন্তু একটা টাইট বাজেটের মধ্যে আছি। সেখানে জনপ্রশাসনে এত ব্যয় কেন থাকবে? এই টাকাটা তো কোনো না কোনো জায়গা থেকে নেওয়া হচ্ছে। হয় শিক্ষা, না হয় স্বাস্থ্য খাত। যেগুলো আমাদের অগ্রাধিকার, সেখান থেকে এই টাকাটা এসে এখানে যোগ হচ্ছে। আমার কথা হচ্ছে, অন্তত দুটো বছর আমরা জনপ্রশাসনের কাজ ছাড়া অন্য খাতগুলোর দিকে গুরুত্ব আরোপ করি। আর আপনার প্রশ্নের উত্তরটা হচ্ছে, এই সমস্যা নির্মূলের জন্য আমাদের প্রয়োজন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক, প্রকল্পভিত্তিক ইন্টারনাল বাই এনরোল। বছরে দুইবার পরিবীক্ষণ। অর্থাৎ ছয় মাস পরে প্রকল্প যেগুলো চলমান, সেগুলোর একটা অ্যাসেসমেন্ট হবে। একটা ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্ট হবে– যেখানে দেখা হবে কোন প্রকল্পের অগ্রগতি কেমন। অগ্রগতি যদি আশানুরূপ না হয়, তবে কেন নয়, সেই সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। বছর শেষে যদি এই সমস্যা সমাধান না হয়, তবে দেখতে হবে এটা পরিচালকের অদক্ষতার জন্য হয়েছে কিনা, সেখানে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, পুরো সমস্যার মূলে হচ্ছে আমাদের জবাবদিহিতার অভাব। আমি যদি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে স্বচ্ছতাও নিয়ে আসতে পারব। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় আছে, যেগুলো বাস্তবায়ন কম হয়, সেখানে আরও জোর দিতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয় তাদের ওপরই করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে, বলে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

সায়মা হক: দেখুন, কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমার কোনো দ্বিমত নেই। তবে করটা তাদের ওপর দেওয়া উচিত, যারা বিপুল সম্পদের মালিক। যদি এমনটা করা হয়, তাহলে আমাদের সামাজিক বৈষম্য কমাতে এটা কাজে আসবে। মধ্যম আয়ের যারা, তাদের জন্য কর প্রপোর্শনাল না। তাই এখানে ব্র্যাকেটে আরও কাজ করা উচিত। করের বিষয়টা যদি ডিজিটালি মানুষকে আরও উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে আরও ভালো হবে। এবং জেলা-উপজেলা অনুযায়ী আলাদাভাবে এগুলো করা সম্ভব।

ভয়েস অফ আমেরিকা: রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সব ক্ষেত্রেই অভিন্ন ভ্যাট হার নির্ধারণ করাটা কতটা কার্যকর হবে? এবারেই কি এটি করা উচিত ছিল? কতদিনের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জনের টার্গেট নেওয়া উচিত?

সায়মা হক: দেখুন, এ বিষয়টাতে কিছু তর্কবিতর্কের অবকাশ থাকে। ২০১২ সাল থেকে এই বিষয়টা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেই হিসেবে আমরা কোনো ফলপ্রসূ রেজাল্ট দেখিনি। এখানে একটা বিষয় হচ্ছে অটোমেশন, আমরা যদি ব্র্যাকেটটা মেইনটেইন করতে না পারি তাহলে রেজাল্ট আসবে না। আমার মতে, আগে অটোমেশন করে তারপর ভ্যাট নির্ধারণ করতে হবে পণ্য বুঝে। যেমন ধরুন– রিসেন্টলি ইন্টারনেটের চার্জ বাড়ল, মোবাইল ফোনের ওপরে চার্জ বাড়ল। এখানে ছোট ছোট এসব বিষয়ে কর বাড়িয়ে কঠিন সেক্টরগুলোতে কোনো প্রেশার ক্রিয়েট না করাটা এক ধরনের ইমব্যালেন্স হয়ে যায়। তাই এটা ঠিক করাটা হলো ফার্স্ট স্টেজ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না। কেন? এবারের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? এর তিনটি ইতিবাচক দিক বলবেন? প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন কোন দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত; যা এবারের বাজেটে সেভাবে দেওয়া হয়নি।

সায়মা হক: দেখুন, প্রতিরক্ষা খাতের কথা বলা একটু কঠিন। প্রতিরক্ষা খাতে কতটুকু বরাদ্দ হওয়া উচিত, সেই বিষয়টা জানতে হলে ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল পরিস্থিতির একটা অ্যাসেসমেন্ট দরকার। এর তেমন তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে নেই, সুতরাং আমরা এটা সেভাবে বলতে পারব না। তবে সার্বিকভাবে আমার যেটা মনে হয় আমাদের অর্থনীতি যেহেতু এখন সংকোচনশীল অবস্থায় আছে, সেখানে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর যৌক্তিকতা আমি দেখি না।

 

সাক্ষাৎকারটি ভয়েস অব আমেরিকায় ২৫ শে জুন ২০২৪ এ প্রকাশিত হয়।